ব্যতিক্রমী আবহে পবিত্র হজ আজ

‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।’ অন্য বছর ৯ জিলহজ তারিখের দিন লাখ লাখ কণ্ঠে উচ্চারিত তালবিয়ার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠতো আরাফাত ময়দান। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। মহামারি করোনার কারণে সৌদি আরবের বাইরে কোনো দেশ থেকে কেউ পবিত্র হজপালনের সুযোগ পায়নি। মাত্র দশ হাজার হজযাত্রী এবার হজপালন করছেন।

যুদ্ধ ও মহামারির কারণে এর আগেও হজ সীমিত মানুষের উপস্থিতিতে হয়েছে। তবে সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর প্রতিবছরই অনেকটা নির্বিঘ্নেই হজ পালিত হয়েছে। সেই ইতিহাসে এবার যোগ যোগ হলো- ভিন্নমাত্রার হজ।

নজিরবিহীন স্বাস্থ্যবিধি সুরক্ষা ও সৃশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বুধবার (২৯ জুলাই) সকাল থেকে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। মক্কায় চারদিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে এদিন সকালে মক্কা থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে হাজিরা ‘কারনুল মানাযেল’ নামক মিকাত থেকে ইহরাম পরিধান করে মক্কায় এসে তাওয়াফে কুদুম শেষে মিনাযাত্রা করেছেন। মিনাযাত্রার মধ্য দিয়ে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে এই প্রথম সৌদি সরকার হজে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। হজ করতে না পেরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ লাখ লাখ মুসলমান গভীর মর্মপীড়ায় ভুগছেন। তাওয়াফে কুদুমের আনুষ্ঠানিকতায় এবার দেখা গেছে অচেনা দৃশ্য। চিরচেনা ভিড় নেই। নেই মক্কার অলি-গলিতে ইহরাম পরিহিত হাজিদের ব্যস্ততা। করোনাকালে অনেকটা বিষাদের আবহেই শুরু হয়েছে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজের আনুষ্ঠানিকতা।

১০ হাজার হাজি বুধবার জোহরের নামাজ আদায় করেছেন মিনায়। মিনায় এবার হাজিরা চির পরিচিত খিমায় (তাঁবু) থাকেননি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের রাখা হয় মিনায় অবস্থিত উন্নতমানের টাওয়ারে। সেখানে রাতভর কোরআন তেলাওয়াত, নফল ইবাদত ও জিকির-আজকারে মশগুল ছিলেন।

মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় শেষে বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) ফজরের পর মিনা থেকে যাবেন আরাফাতের ময়দানে। আরাফার ময়দানই হলো- হজের মূল কার্যক্রম। অন্য বছর আরাফাতের বিস্তীর্ণ ময়দানজুড়ে হাজিরা অবস্থান নিলেও এবার নির্দিষ্ট তাঁবুতে থাকতে হবে। সৌদি আরবের স্থানীয় সময় ১২টা ২৫ মিনিটে আরাফাতের ময়দান সংলগ্ন মসজিদে নামিরা থেকে হাজিদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করা হবে।

এবার হজের খুতবা দেবেন শায়খ আবদুল্লাহ বিন সোলায়মান আল মানিয়া। তিনি সবচেয়ে বেশি বয়স্ক হজের খতিব। এ বছর হজের আরবি খুতবা বাংলাসহ আরও নয়টি ভাষায় অনুবাদ করে সম্প্রচার করা হবে। এ লক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ওই নয় ভাষা হলো- ইংরেজি, মালয়, উর্দু, ফার্সি, ফ্রেঞ্চ, মান্দারিন, তুর্কি, রুশ ও হাবশি। ২০১৯ সালে ৫ ভাষায় হজের খুতবার অনুবাদ প্রচার করা হয়েছিল।

আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। লাখো মানুষের উদ্দেশে প্রদত্ত এই ভাষণের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছিল দ্বীনের পরিপূর্ণতা লাভের। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এখনও ভাষণ দেওয়া হয়। ভাষণে বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়। উপস্থিত হাজিরা আবেগঘন পরিবেশে মহান আল্লাহর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার মন-মানসিকতা নিয়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। তারা নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, নিজের পরিবার-পরিজন, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুখ শান্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।

হাজিরা আরাফাতের ময়দানে সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ না পড়ে চলে যাবেন মুজদালিফায়। সেখানে গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজানে আলাদা আলাদা ইকামতে একসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আদায় করবেন। মুজদালিফায় সারারাত খোলা আকাশের নিচে সারারাত অবস্থান করবেন এবং সেখানেই ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্য ওঠার আগে কিছুক্ষণ অবস্থান করে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করার জন্য ফের চলে যাবেন মিনায়। ১০ জিলহজ মুজদালিফা থেকে মিনায় এসে বড় জামরাতে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করবেন এবং এ কাজ জোহরের আগেই সম্পন্ন করবেন। বড় জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করে কোরবানির কাজও সম্পন্ন করবেন হজিরা। সেই সঙ্গে নিজেদের মাথা মুণ্ডন করে ইহরামের কাপড় থেকে হালাল হবেন।

১১ ও ১২ জিলহজ সূর্য ডোবার আগে তাওয়াফে জিয়ারতের কাজ সম্পন্ন করবেন এবং এ দু’দিন মিনায় অবস্থান করে ছোট, মধ্যম ও বড় জামারায় সাতটি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করে ১২ জিলহজ সূর্য ডোবার আগে মিনা ত্যাগ করবেন। এরপর বিদায়ী তাওয়াফের মাধ্যমে হজের কাজ সম্পন্ন করবেন হাজিরা।

চলতি হজে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ সৌদি নাগরিক ও ৭০ শতাংশ সৌদি প্রবাসী বিদেশি বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে রয়েছে ১৬০ দেশের প্রতিনিধি।

কোভিড-১৯ মহামারি এবারের হজ আয়োজনকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছিল। সৌদি আরবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর দেশের ৯০ হাজার মসজিদের জামাতে নামাজ আদায় বন্ধ করে দিয়েছিল সৌদি সরকার। মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে সীমিত মানুষের উপস্থিতিতে জামাত চালু ছিলো। পরে মসজিদে নববীসহ দেশের সব মসজিদ জামাদের জন্য খুলে দিলেও মসজিদের হারামে এখনও সর্ব সাধারণকে নামাজের অনুমতি দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন পর বুধবার তাওয়াফে কুদুমের জন্য ১০ হাজার হাজি মসজিদের হারামে প্রবেশ করে তাওয়াফের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে টানা তিন মাস ধরে লকডাউনে ছিল সৌদি আরব। এ সময় দেশটির অধিকাংশ শহরে ২৪ ঘণ্টা কারফিউ জারি ছিল।

এবারের হজে অংশগ্রহণকারীরা মক্কায় উপস্থিত হওয়ার পরপরই তাদের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা ও ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে। হজ শুরুর আগে ও পরে তাদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মহামারির কারণে এবারের হজের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি জারি করেছে সৌদি আরবের জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। বিধি অনুযায়ী, হজ পালনকারীরা কাবা শরিফে ও কালো পাথরে চুমু খেতে বা স্পর্শ করতে পারবেন না এবং শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর ছুড়ে মারার জন্য আগে থেকে জীবাণুমুক্ত প্যাকেটজাত পাথর ব্যবহার করতে হবে। যা হাজিদের সরবরাহ করা হয়েছে।

হজ পালনকারী ও হজে দায়িত্ব পালনকারীদের অবশ্যই সুরক্ষা মাস্ক পরতে হবে এবং তা ব্যবহার শেষে সুনির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। হজ পালনকারীরা যেখানেই সমবেত হোন না কেন, দু’জনের মধ্যে অন্তত দেড় মিটার দূরত্ব রাখতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি পালনের জন্য ৫০ জনের সমন্বয়ে একেকটি দল গঠন করা হয়েছে। তাদের নেতৃত্বে থাকবেন একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করবেন।

হজ পারমিট ছাড়া হজের জন্য পবিত্র স্থান মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের ময়দানে হজের পঞ্চম দিন ১২ জিলহজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ। অন্য দেশ থেকে আসা কেউ হজের আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দিতে এলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বুধবার মিনার পাহাড় ডিঙিয়ে হজের আনুষ্ঠানিকতায় শরিক হতে এসে ২৪৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সচ্ছল প্রতিটি মুসলিমের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। বিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলমানদের জন্য হজ একটি পবিত্র মাইলফলক। অনেক মানুষ হজের জন্য সারাজীবন ধরে অর্থ সঞ্চয় করে থাকেন। এবার যারা হজ করতে পারেননি, তাদের অনেকেই হয়তো জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের সুযোগ আর পাবেন না। কারণ হজে অংশগ্রহণকারীদের বড় একটি অংশই বয়োবৃদ্ধ হয়ে থাকেন। তবে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, এবার সুযোগ না পেলেও তারা আগামীতে হজের নিয়ত রাখবেন, সেভাবে প্রস্তুত থাকবেন। ভালো হয় নিজের হজের ইচ্ছার কথা, ওয়ারিশদের অসিয়ত করে যাওয়া। অগত্যা হজ না করে মারা গেলেও তার পক্ষে যেনো বদলি হজ করা হয়।

হাজিদের নির্বিঘ্নে হজব্রত পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সৌদি সরকার। ইতোমধ্যে হজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সিভিল ডিফেন্স কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক এবং মিডিয়া কর্মী নিয়োগ দেওয়াসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জামে বিশেষজ্ঞ নিরাপত্তা কর্মীরা দায়িত্ব পালন করছে বলে জানিয়েছে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রস্তুত রয়েছে বেশ কয়েকটি হাসাপাতাল, ২শ’ অ্যাম্বুলেন্স ও কয়েকটি হেলিকপ্টার।